মহাবিশ্ব কাকে বলে? | মহাবিশ্বের আদ্যোপান্ত

মহাবিশ্বের আদ্যোপান্ত


মহাবিশ্ব কাকে বলে, মহাবিশ্বের ইতিহাস কিংবা মহাবিশ্বের উৎপত্তিই বা কীভাবে এ নিয়ে আমাদের আগ্ৰহের অন্ত নেই। অবশ্য এ আগ্ৰহটা দোষের কিছু নয়। কেননা মানুষ  হিসেবে আমরা স্বভাবগত ভাবেই আগ্ৰহী। অজানাকে জানার, নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আশায় পিপাসার্ত থাকি আমরা অনেকেই। আজকের এই আর্টিকেলটিতে আমরা মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্কিত এসকল বিষয়াদি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

মহাবিশ্ব কাকে বলে?

মহাবিশ্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে সেটা হলো মহাবিশ্ব কী বা মহাবিশ্ব কাকে বলে? এক কথায় যদি বলি তবে স্থান ও সময় এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয় নিয়েই আমাদের মহাবিশ্ব। কিংবা একটু বিস্তৃত ভাবে যদি বলা যায় তবে, 

আমরা বলতে পারি সকল গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ধূমকেতু, ব্ল্যাক হোল সহ সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুকে একত্রে মহাবিশ্ব বলে। এমনকি সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু যে অসীম শূন্যস্থানে বিরাজ করছে তা-ও আমাদের মহাবিশ্বের অংশ। তবে শুধু এই অসীম সংখ্যক মহাজাগতিক বস্তু বা মহাশূন্যই নয়, সময়ও মহাবিশ্বের একটি অপরিহার্য অংশ।

অর্থাৎ, বলা যেতে পারে যে, সকল মহাজাগতিক বস্তু বা শক্তি, মহাশূন্য ও সময়ের যে সমষ্টি বিবেচনা করা করা হয় তা-ই মহাবিশ্ব। আমাদের পৃথিবী এবং এর উপগ্রহ চাঁদ মহাবিশ্বের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ, যেমন টি অন্যান্য গ্রহ এবং তাদের ডজন ডজন উপগ্রহও। মানুষ, পশুপাখি সহ কেউ-ই এর বাইরে নয়। মহাবিশ্বের সৃষ্টি থেকে শুরু করে এক অতি দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে মহাজগতের এসকল উপাদান। 

আমাদের পর্যবেক্ষণ-লব্ধ মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন parsec (৩০০ বিলিয়ন light-year)। পুরো বিশ্বের আকার অজানা হলেও এর উপাদান ও সৃষ্টিধারা নিয়ে বেশ কয়েকটি hypotheses বিদ্যমান । মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়কে বলা হয়ে থাকে বিশ্বতত্ত্ব। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সুদূরতম প্রান্তের পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক গবেষণায় মনে হয় মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রক্রিয়াই তার সৃষ্টি থেকেই একই ধরনের প্রাকৃতিক নিয়ম ও কয়েকটি নির্দিষ্ট ধ্রুবক দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিগ ব্যাং (Big Bang) তত্ত্ব অনুসারে এর আয়তন ক্রমবর্ধমান। সম্প্রতি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তত্ত্বে আমাদের এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের পাশাপাশি আরো অনেক মহাবিশ্ব থাকার অর্থাৎ অনন্ত মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে।

মহাবিশ্বের ইতিহাস

মহাবিশ্বের ইতিহাস

মহাবিশ্বের সংজ্ঞা জানার পরেই যে বিষয়টি আমাদের মাথায় আসে সেটি হলো মহাবিশ্বের ইতিহাস। প্রাচীন কালে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য নানাবিধ বিশ্বতত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া হত। পুরাতন গ্রিক দার্শনিকরাই প্রথম এই ধরনের তত্ত্বে গাণিতিক মডেলের সাহায্য নেন এবং পৃথিবী কেন্দ্রিক একটি মহাবিশ্বের ধারণা প্রণয়ন করেন। তাদের মডেলে পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহ, সূর্য ও নক্ষত্ররা ঘুরছে। গ্রীকদের এই মডেলে মহাবিশ্বের মোট আয়তন বর্তমানে জ্ঞাত বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মধ্যেই ছিল। তারা ভেবেছিলেন আকাশের তারারা আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়।

বেশ কয়েক জন জ্যোতির্বিদ পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেও যতদিন না চৌদ্দশো শতকে কোপের্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে যৌক্তিক ভাবে তার বইয়ে উপস্থাপনা করলেন ততদিন পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণা মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে গেঁড়ে ছিল। পরবর্তীকালে নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ সংক্রান্ত গভীর ধারণা পর্যবেক্ষণের সাথে সৌরকেন্দ্রিক জগতের সামঞ্জস্য নির্ধারণ করে। ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেন সূর্যের মতই কোটি কোটি তারা দিয়ে একটি গ্যালাক্সি গঠিত। কয়েক শত বছর বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সমগ্র মহাবিশ্ব মানে শুধুমাত্র আমাদের এই ছায়াপথ গ্যালাক্সিটিই। ১৯২০র দশকে উন্নত দুরবীনের কল্যাণে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন ছায়াপথের বাইরে অন্য গ্যালাক্সিদের।

সেই কোটি কোটি গ্যালাক্সিদের মধ্যে ছায়াপথের মতই কোটি কোটি তারাদের অবস্থান। সেই সমস্ত গ্যালাক্সিদের থেকে আগত আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণে বোঝা গেল সেই গ্যালাক্সিগুলি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

তবে এর সহজতম ব্যাখ্যা হচ্ছে গ্যালাক্সিদের মধ্যে স্থানের প্রসারণ হচ্ছে এবং প্রতিটি গ্যালাক্সিই অন্য গ্যালাক্সি থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরছে।


মহাবিশ্বের উৎপত্তি

আমরা যারা এতক্ষণ মহাবিশ্বের সংজ্ঞা এবং মহাবিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে জানলাম, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন ভাবছেন আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে হলো ?

বিজ্ঞানীদের ধারণা হল সুদূর অতীতে সমস্ত গ্যালাক্সিগুলি বা তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত পদার্থই একসাথে খুব ঘন অবস্থায় ছিল এবং কোন মহা বিস্ফোরণের ফলে বস্তুসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হল বিগ ব্যাং। ১৯৬০এর দশকে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাংএ সৃষ্ট উষ্ণ বিকিরণের শীতল অবশেষের সন্ধান পেলেন। এই তরঙ্গ বিগ ব্যাং ঘটনার প্রায় ৪০০,০০০ বা চার লক্ষ বছর পরে, বস্তু ঘনত্বের হ্রাসের পর, মুক্ত হয়েছিল। এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মহাবিশ্বের প্রতিটি জায়গাতেই পাওয়া যায়। এক অর্থে বলা যায় এই তরঙ্গ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ ত্বরাণ্বিত হচ্ছে। এই আবিষ্কারটি বিশ্বতত্ত্বের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিল।

বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী আমাদের এ মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা ভীষণ ঘন ও উষ্ণ দশা থেকে। এই অবস্থাকে প্ল্যাঙ্ক ইপোখ বলে অভিহিত করা যায়। সেই সময় থেকে প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, শুরুর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মহাবিশ্বের অতি স্ফিতী (inflation) হয় যা কিনা দেশ বা স্থানের প্রতিটি অংশে প্রায় একই তাপমাত্রা স্থাপন করতে সাহায্য করে। এই সময়ে সুসম ঘনত্বের মাঝে হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যত গ্যালাক্সি সৃষ্টির বীজ তৈরি হয়। মহাকর্ষ শক্তির মাধ্যমে সম্প্রসারণের বিরূদ্ধে বস্তুজগতকে আকর্ষিত করে গ্যালাক্সি সৃষ্টির পেছনে কৃষ্ণ বা অন্ধকার বস্তুর বিশেষ ভূমিকা আছে। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণের মাত্রার ত্বরণের জন্য কৃষ্ণ বা অন্ধকার শক্তি বলে একটি জিনিসকে দায়ী করা হচ্ছে। তাত্ত্বিক ভাবে কৃষ্ণ বস্তু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য বলগুলোর সাথে (তড়িৎ-চুম্বকীয়, সবল ও দুর্বল) খুব অল্পই বিক্রিয়া করে সেইজন্য ডিটেকটর দিয়ে তাকে দেখা মুশকিল। বর্তমান মহাবিশ্বের মূল অংশই হচ্ছে কৃষ্ণ শক্তি, বাকিটা কৃষ্ণ বস্তু। আমরা চোখে বা ডিটেকটর মাধ্যমে যা দেখি তা মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশের কম। এই মডেলে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়েস ১৩.৭৫ বিলিয়ন বা ১,৩৭৫ কোটি বছর। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের "এই মুহূর্তের" ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোক বছর। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিটি বিন্দু থেকে প্রতি মুহূর্তে আরো দ্রুত সরছে, মহাবিশ্বের ব্যাস ১৩.৭৫ x ২ = ২৭.৫০ বিলিয়ন আলোক বছরের চাইতে বেশি। দেশ বা স্থানের প্রতিটি বিন্দু বহু দূরের কোন বিন্দুর তুলনায় আলোর গতির উর্ধে ভ্রমণ করে, যতক্ষণ না সেই বিন্দুগুলির মাঝে তথ্য আদানপ্রদান না হচ্ছে এই গতি বিশেষ বা সাধারণ আপেক্ষিকতার কোন নিয়ম ভঙ্গ করে না।


তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

Post a Comment

Previous Post Next Post