আমরা বেশিরভাগ মানুষ কম্পিউটার কি? এর সংজ্ঞা জানলেও প্রকৃতপক্ষে কম্পিউটারের ব্যবহার, কম্পিউটার সৃষ্টির ইতিহাস কিংবা কম্পিউটারের প্রকারভেদ সম্পর্কিত বিষয়াদি সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞাত। আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার এক মহা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বর্তমান যুগ ইনফরমেশন ও টেকনোলজি নির্ভর হওয়ায় এর চাহিদা দিন দিন ক্রমশই বেড়ে চলেছে। আজকের এই আর্টিকেলটিতে আমরা কম্পিউটার নিয়ে অজানা কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ -
কম্পিউটার কি?
কম্পিউটার হলো এমন একটি যন্ত্র যা সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অনুসরণ করে গাণিতিক গণনা সংক্রান্ত কাজ খুব দ্রুত করতে পারে। কম্পিউটার (Computer) শব্দটি গ্রিক "কম্পিউট" (compute) শব্দ থেকে এসেছে। Compute শব্দের অর্থ হিসাব বা গণনা করা। আর কম্পিউটার (Computer) শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। কিন্তু এখন আর কম্পিউটারকে শুধু গণনাকারী যন্ত্র বলা যায় না। কম্পিউটার এমন এক যন্ত্র যা তথ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করে। সভ্যতার বিকাশ এবং বর্তমানে তার দ্রুত অগ্রগতির মূলে রয়েছে গণিত ও কম্পিউটারের প্রবল প্রভাব।
আধুনিক কম্পিউটারের জনক কে?
আধুনিক কম্পিউটারের জনক হলো বিজ্ঞানি চার্লস ব্যাবেজ। তিনি ছিলেন একজন ইংরেজি যন্ত্র প্রকৌশলী, গণিতবিদ, আবিস্কারক এবং দার্শনিক। চার্লস ব্যাবেজের জন্ম ১৭৯১ সালে লন্ডনে।
১৮১০ সালে তিনি প্রথম যান্ত্রিক উপায়ে সংখ্যা গণনা করার যন্ত্র ব্যবহার করার কথা চিন্তা করেন। এর পরে তিনি ১৮৩০ সালে একটি যন্ত্র তৈরি করার পরিকল্পনা করেন, যেটা পাঞ্চড কার্ডের মাধ্যমে চালানো হবে। এটার মাধ্যমে একের পর এক কার্য সম্পাদন করতে পারবে।
এই তৈরি করা যন্ত্রকে আধুনিক কম্পিউটারের প্রথম সংস্কারণ হিসাবে ধরা হয়, যেটা অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্ত দুঃখ জনক ব্যাপার হলো Charles Babbage অর্থের অভাবে পরিকল্পনাটি সম্পূর্ন করতে পারেন নি।
এরপরেও তার তৈরি করা এই অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন যান্ত্রিক ভাবে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধার করতে পারতো। এই সকল দিক থেকে Charles Babbage কে বলা হয় কম্পিউটারের জনক (father of the computer).
কম্পিউটারের পুরো নাম (Full meaning of computer):
C-Commonly
O-Operating
M-Machine
P-Particularly
U-Used for
T-Technology
E-Education and
R-Research
অর্থাৎ আমরা বলতে পারি "Commonly Operating Machine Particularly Used for Technical Education and Research"
কম্পিউটার সৃষ্টির ইতিহাস:
প্রাগৈতিহাসিক যুগে গণনার যন্ত্র উদ্ভাবনের বিভিন্ন প্রচেষ্টাকে কম্পিউটার ইতিহাস হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। প্রাচীন কালে মানুষ সংখ্যা বুঝানোর জন্য ঝিনুক, নুড়ি, দড়ির গিট ইত্যাদি ব্যবহার করত। পরবর্তীতে গণনার কাজে বিভিন্ন কৌশল ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকলেও অ্যাবাকাস (Abacus) নামক একটি প্রাচীন গণনা যন্ত্রকেই কম্পিউটারের ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এটি আবিষ্কৃত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সালে ব্যাবিলনে। অ্যাবাকাস ফ্রেমে সাজানো গুটির স্থানকে পরিবর্তন করে এ গণনা করার যন্ত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০/৫০০ অব্দে মিশরে অথবা চীনে গণনা যন্ত্র হিসেবে অ্যাবাকাস তৈরি হয়।
১৬১৭ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনার কাজে ছাপা বা দাগ কাটাকাটি অথবা দন্ড ব্যবহার করেন। এসব দন্ড জন নেপিয়ার (John Napier) এর অস্থি নামে পরিচিত। ১৬৪২ সালে ১৯ বছর বয়স্ক ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তিনি দাঁতযুক্ত চাকা বা গিয়ারের সাহায্যে যোগ বিয়োগ করার পদ্ধতি চালু করেন। ১৬৭১ সালের জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড ভন লিবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রের ভিত্তিতে চাকা ও দন্ড ব্যবহার করে গুণ ও ভাগের ক্ষমতাসম্পন্ন আরো উন্নত যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। তিনি যন্ত্রটির নাম দেন রিকোনিং যন্ত্র (Rechoning Mechine)। পরবর্তীতে ১৮২০ সালে টমাস ডি কোমার রিকোনিং যন্ত্রটি পরিমার্জন করে লিবনিজের যন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
উনিশ শতকের একেবারেই শুরুর দিকে আধুনিক একটি যন্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহারের ধারণা (যা কেবলমাত্র যান্ত্রিকভাবে, মানে যেকোনও রকম বুদ্ধিমত্তা ব্যতিরেকে, গাণিতিক হিসাব করতে পারে) প্রথম সোচ্চার ভাবে প্রচার করেন চার্লস ব্যাবেজ। তিনি যন্ত্রটির নাম দেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine)। এই ডিফারেন্স ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার সময় (১৮৩৩ সালে) তিনি অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন নামে আরও উন্নত ও সর্বজনীন একটি যন্ত্রে ধারণা লাভ করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও অর্থের অভাবে কোনোটির কাজই তিনি শেষ করতে পারেননি।
কম্পিউটার বিজ্ঞানের সত্যিকার সূচনা হয় অ্যালান টুরিং এর প্রথমে তাত্ত্বিক ও পরে ব্যবহারিক গবেষণার মাধ্যমে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আধুনিক কম্পিউটারের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবনের ফলে মাইক্রোকম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। বাজারে প্রচলিত হয় বিভিন্ন প্রকৃতি ও আকারের কম মূল্যের অনেক রকম পার্সোনাল কম্পিউটার (Personal Computer) বা পিসি (PC)। সে সঙ্গে উদ্ভাবিত হয়েছে অনেক রকম অপারেটিং সিস্টেম, প্রোগ্রামের ভাষা, অগণিত ব্যবহারিক প্যাকেজ প্রোগ্রাম। এরসাথে ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের এবং সংশ্লিষ্ট সেবা ও পরিসেবার। কম্পিউটার শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে অসংখ্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কম্পিউটার শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক কালে কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি (Information Technology) বা আইটি (IT) ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট অংশ দখল করেছে এবং কর্মসংস্থান হয়ে পড়েছে অনেকাংশেই কম্পিউটার নির্ভর।
মাইক্রোপ্রসেসর ভিত্তিক কম্পিউটার:
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেল কর্পোরেশন ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবন করার পর থেকে বাজারে আসতে শুরু করে মাইক্রোপ্রসেসর ভিত্তিক কম্পিউটার। তখন থেকে কম্পিউটারের আকৃতি ও কার্যক্ষমতায় এক বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়। ১৯৮১ সালে বাজারে আসে আই.বি.এম কোম্পানির পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি। এর পর একের পর এক উদ্ভাবিত হতে থাকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোপ্রসেসর এবং তৈরি হতে থাকে শক্তিশালী পিসি। আই.বি.এম কোম্পানি প্রথম থেকেই আই.বি.এম কমপ্যাটিবল কম্পিউটার (IBM compatible computer) তৈরির ক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ না রাখায় এ ধরনের কম্পিউটারগুলির মূল্য ব্যাপকহারে হ্রাস পায় এবং এর ব্যবহারও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একই সময় আই.বি.এম কোম্পানির পাশাপাশি অ্যাপল কম্পিউটার ইনকর্পোরেট (Apple Computer Inc) তাদের উদ্ভাবিত অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ (Apple-Macintosh) কম্পিউটার বাজারে ছাড়ে। কিন্তু অ্যাপল কোম্পানি তাদের কমপ্যাটিবল কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে কোনোরূপ উদারতা প্রদর্শন না করায় ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের মূল্য থেকে যায় অত্যধিক বেশি, যার ফলে অ্যাপল তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে নি। তবে বিশেষ ধরনের কিছু ব্যবহারিক সুবিধার কারণে মূলত মুদ্রণ শিল্পে অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।
আজ এই আর্টিকেলটিতে আমরা জানলাম কম্পিউটার কি, কম্পিউটারের পুরো নাম, কম্পিউটারের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়াদি সম্পর্কে। Technology সম্পর্কিত এধরনের আরও আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ধন্যবাদ