মিশরের ফুটবল সম্রাট (মোহাম্মদ সালাহ)
শুরুটা হয় একটা ছোট্ট, নোংরা আর ধূলিময় মাঠের গল্প দিয়ে। একটা স্বপ্নের মাঠ, যেখানে মিশে আছে ভালোবাসা, আবেগ আর হাজারো ঘাম ঝড়ানো মুহুর্ত। গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন মনে হয় মাঠজুড়ে ৭-১০ বছরের মোট নয়টি শিশু এক ফুটবল নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। যাদের মাঝে কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো বিরক্তি নেই। চারপাশের উঠতি ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর কারণে জেসমিনের কড়া সৌরভ ঘুরেফিরে যেন এই মাঠের মধ্যেই আটকে যাচ্ছে। তাতে যেন পরিবেশটা আরও কিঞ্চিত স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে। তবে মাঠটা কোথায়? বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, মিশরে। আর দেশটির রাজধানী কায়রো থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণে নাগরিগ শহরে।
এই যে এক টুকরো মাঠ, যা নিয়ে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে এত কথা, তার বুকে নয়টি ছেলে খেলছে, তাদের কোনো দুঃখ নেই আজ। মাঠটি যেন নিজেও আজ গর্বিত। কারণ তার বুকেই যে গড়ে উঠেছে বিশ্ব ফুটবলের নতুন তারকা। যে বাচ্চাগুলো ময়লা কাপড় আর ছেঁড়া জুতো পরে বলে কষে লাথি দিচ্ছে, নাগরিগের এত অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যেও তারা আজ যেন অনেক খুশি। কারণ তাদের প্রিয় মোহাম্মদ সালাহ জন্মেছেন তাদের এখানেই। ফুটবলের শুরুটা করেছিলেন এই এবড়োথেবড়ো মাঠেই। আর সেই নাগরিগের সালাহ থেকেই আজ লিভারপুলের সালাহ হয়ে ওঠার নতুন গল্প লিখেছেন মিশরের ইতিহাসের পাতায়।
ইউরোপীয় ফুটবলের চাকচিক্যতা আজকের চকচকে দুনিয়া থেকে দেখলে সালাহ’র উঠে আসার গল্পটা টের পাওয়া যাবে না। তার জন্য আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। নামতে হবে নাগরিগের দুর্গন্ধময়, সরু মফস্বলের রাস্তায়। যে মাঠের কথা এতক্ষণ বলা হল, সেখান থেকে সালাহর বাড়ি মিনিট দুয়েকের পথ। নিস্তব্ধ সেই পথে হাঁটতে গিয়ে আপনি খানিকটা হলেও অনুভব করতে পারবেন তার আদর্শ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা জিনেদিন জিদান আর ফ্রান্সিসকো টট্টিদের অনুকরণ করতে কী সংগ্রামই না করতে হয়েছে তাকে। তবে সঙ্গে এটাও মিশরের নতুন প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, চাইলে তারাও সালাহকে টেক্কা দিতে পারবে। আর নিজের এই অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাকিদের অনুপ্রেরণা হতে পারার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী-ই বা হতে পারে!
যে মিশরের বুকে জন্ম নিয়ে খ্যাতির শিখরে চড়েছেন এই সালাহ, তার দেশও তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে যাচ্ছে। দেশ তো বটেই, ২৪ ঘন্টা আগে জিতেছেন আরব বিশ্বের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারও। তারও আগে জয় করেছিলেন আফ্রিকার সেরা ফুটবলারের তকমাটাও। কিন্তু সবচেয়ে বড় গৌরবটা এনে দিয়েছেন নিজের দেশকে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে কঙ্গোকে হারানোর মাধ্যমে ১৯৯০ সালের পর প্রথম মূল পর্বে জায়গা করে দিয়েছেন মিশরকে। ম্যাচে মিশরের হয়ে প্রথম গোলটি করেন এই সালাহ। সেটা কঙ্গো পরিশোধ করে দিলে যেন স্টেডিয়ামে কান্নার রোল পড়েছিল। কিন্তু আল্লাহ বোধহয় গল্পের শেষ পাতাটা নাটকীয় করেছিলেন শুধুই সালাহর কারণে। তাই হয়তো ম্যাচ শেষ হওয়ার অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি পেল মিশর। যেমনটা ম্যাচের আগেরদিন সকালেই কোচ সালাহ কে বলেছিলেন, “আমরা যদি একটিও পেনাল্টি পাই, সেটা তুমিই শট করবে।”
আর সেই মান রেখেছিলেন সালাহ। মিশরকে বিশ্ব ফুটবলের দরবারে আরও এক নতুন অবস্থানে নিয়ে গেলেন এই জয়ের মধ্যে দিয়ে। সেই খুশিতে মিশরের শীর্ষ ক্লাব জামালেকের সাবেক সভাপতি সালাহকে একটি ভিলা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। উল্টো তার নাগরিগ এলাকার জন্য তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন।
সালাহর বিনয় নিয়ে অনেক সুনাম রয়েছে। যখন থেকে তিনি মোটা অংকের অর্থ উপার্জন শুরু করেছেন, সবার আগে নিজের এলাকা নাগরিগের উন্নতির জন্য কাজ করা শুরু করেছেন। একখানা জিম স্থাপন করেছেন নিজের নামে। কিন্তু তা সবার জন্যই উন্মুক্ত। নিজ উদ্যোগে ফুটবল খেলার উপযোগী এক পিচ করে দিয়েছেন আইয়াদ আল-তানতাওয়ে স্কুলে, যেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন। সর্বোপরি নাগরিগকে তিনি দিয়েছেন বেঁচে থাকার আশ্বাস-অনুপ্রেরণা। অর্থের ঝনঝনানিতে বুট পায়ে লিভারপুল জয় করে যাচ্ছেন, ইউরোপীয় ফুটবলকে শাসন করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রতিনিয়তই। কিন্তু তিনি মাটিতেই পা রাখছেন। ভুলে যাননি তিনি নিজের শিকড়কে। এমনকি তারকা হওয়ার পর যখন তার ঘরে এক চোর চুরি করতে ঢুকেছিল, তার বাবা সেই চোরের নামে মামলা করেন। চোর ধরা পড়লে সালাহ তাকে ছাড়িয়ে আসেন! শুধু কী তা-ই? তিনি তাকে আর্থিক সাহায্যও করেন। এরপর জীবন বদলানোর পরামর্শ দিয়ে তাকে চুরি ছাড়তে বলেন!
তার বন্ধু মোহাম্মদ বাসিওয়নির ভাষায় যদি বলি, “সে প্রতি রমজানে নাগরিগে আসে। এখানকার বাচ্চাদের উপহার দেয়। পুল (বিলিয়ার্ড) খেলে, টেবিল টেনিস খেলে।”
এখানকার ভক্তদেরও খুব ভালোবাসেন এই সালাহ, এমন খবরও পাওয়া গেল তার এই ছোটবেলার বন্ধুর কাছে যে, “অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য সবাইকে সে সই করে দেয়। সবার সঙ্গে ছবি তোলে। সে বদলে যায়নি।”
এই কথাগুলো সালাহর বন্ধু বাসিওয়নি বলছিলেন নাগরিগে সালাহ’র সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটায় দাঁড়িয়ে। এটা একটা ক্যাফে, যার মালিক হলেন বাসিওয়নি নিজেই। যে ক্যাফের একদিকে কোনো দেয়াল নেই। বড় একটা টিভিতে শুধুই ফুটবল চলে। ইউরোপ, মিশর দাবড়ে বেড়িয়েও এই ভাঙাচোরা ছোট্ট ক্যাফেটাই হচ্ছে সালাহর সবচেয়ে আপন জায়গা। সালাহকে নিয়ে বলতে গিয়ে খানিকটা নস্টালজিয়ায় ভুগলেন কিনা বাসিওয়নি! আনমনেই বলে যেনো বলে উঠলেন, “তার অনেকদূর যাওয়ারই কথা ছিল। আমরা সবাই একসাথে ফুটবল খেলতাম। তার ভাই নাসেরও আমাদের সাথে যোগ দিত। কিন্তু আমরা কেউ মোহাম্মদের (সালাহ) কাছ থেকে বল নিতে পারতাম না। তখন থেকেই আমরা জানতাম ও উপরে উঠবেই।”
ক’দিন আগেও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে সালাহর করা জোড়া গোলে লেস্টার সিটিকে হারিয়েছিল লিভারপুল। ২০১৭ সালে লাল জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ পাওয়ার পর সালাহর পারফরম্যান্সটাও হয়ে উঠেছে নজরকাড়া। এখন পর্যন্ত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গোল করেছেন মোট ২২টি, যার মধ্যে অ্যাসিস্ট ৬টি।
এসবের শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। সালাহ যখন ১৪ বছরের কিশোর তখন স্কুলে স্কুলে পেপসি লিগের আয়োজন করতো আরব কন্সটাক্ট্রর এফসি নামের ক্লাব। সেখানেই নজর কেড়ে নেন সালাহ। ক্লাবের পক্ষ থেকে তখন কায়রোতে অনুশীলনের প্রস্তাব দেওয়া হয় সালাহকে। এটাই যেন স্বপ্ন পূরণের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ছেলেটার। কখনও বাবার সাথেই তিনি ২০০ মাইল পাড়ি দিয়ে কায়রো চলে গেছেন। যখন বাবা যাননি, তখন একাই রওয়ানা হয়েছেন। সেক্ষেত্রে নাগরিগ থেকে পাঁচটা বাস বদলাতে হতো তখনকার এই কিশোর ফুটবলারটিকে। এরপর সালাহর আগ্রহ আর পারফরম্যান্স দেখে ক্লাব তাকে আর ফিরতে দেয়নি। মিশরের সেরা তিনটি ক্লাব গুলোর মধ্যে একটি এই আরব কন্সট্রাক্টর। বাকি দুই ক্লাব হচ্ছে জামালেক ও আল-আহ্লেই যখন অভিজ্ঞ ফুটবলারদের উপর নির্ভর করছে, সালাহ’র ক্লাব তখন চোখ রাখছে তরুণদের উদ্দীপনার দিকে।
কোচদের কাছে সালাহ মানেই অন্তপ্রাণ আর বিনয়ী। তাকে হামদি নূর, যিনি কিনা মিশর জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার; তিনি বলেন, ‘‘মোহাম্মদ (সালাহ) ফুটবলের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি ছিল। যখন আমি তাকে দেখতাম, সে বাম পায়ের প্রচুর ব্যবহার করত। আমি বলতাম, ‘তোমাকে ডান পায়ের ব্যবহারও শিখতে হবে’। সে উত্তর দিত, ‘ঠিক আছে, স্যার!’ সবসময়, একই বিনয়ে।’’
সালাহ সবসময় দেশের জন্য কিছু না কিছু করতে চাইতেন। ফুটবল দিয়েই করতে চাইতেন। কোচরাও সেটা জানত। তাই হামদির মতন অন্যরাও তাকে বলত, ‘তুমি যত অনুশীলন করবে, তত বেশি ভাল করতে পারবে। যত ভাল করবে, তত বেশি উপার্জন করতে পারবে।’
সালাহ নিজের সেরাটাই দিতে পেরেছিলেন। তাই নিজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ জয় করতে পেরেছেন। প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা ট্যাকলে, প্রতিটা শটে, প্রতিটা ড্রিবলিংয়ে যেন মোহাম্মদ সালাহ নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা করতে পেরেছেন। হতে পেরেছেন, মিশরের ফুটবল সম্রাট!