সূর্য গ্ৰহণ কী?
যেহেতু আজকের এই আর্টিকেলটি সূর্য গ্ৰহণকে নিয়ে তাই শুরুতেই আমাদের জানা দরকার, সূর্য গ্ৰহণ কী? চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোন দর্শকের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘটনাকে সূর্য গ্রহণ বলা হয়ে থাকে। অমাবস্যার পরে নতুন চাঁদ উঠার সময় এ ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পৃথিবীতে প্রতি বছর অন্তত দুই থেকে পাচঁটি সূর্যগ্রহণ দেখা যায়।
২০১৯ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর যে সূর্য গ্ৰহণটি দেখা যায় তাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় এবং রিং অফ ফায়ার তৈরি হতে দেখা যায়। আরব ভূখণ্ড থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হয় ঐ দিনে।
সূর্য গ্ৰহণের ইতিহাস
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে পরিচিত সূর্যগ্রহণের পর্যায়কাল। ১০০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দেও সূর্য গ্রহণের পূর্বাভাস মানুষ দিতে পারত। ঐ সময় ক্যালান্ডরে জ্যোতিষীরা সূর্য গ্রহণ সম্বন্ধে একটা আশ্চর্য মিল লক্ষ করেন। তারা দেখেন যে ১৮ বছর ১০ দিন পর পর সূর্যগ্রহণ পুনরাবর্তিত হয়। এই থেকে সারোস চক্র দিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণগুলি চিহ্নিত করার প্রথা চালু হয়। সারোস কথাটির লাতিন অর্থ হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। ২২ জুলাই, বাংলাদশে থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যায় যা ছিল ১৩৬ সারোসচক্রের ৩৭ তম গ্রহণ মোট সংখ্যা ৭১টার মধ্যে। প্রতিটি সারোসচক্র আবার প্রায় ৭৫টি গ্রহণে সমাপ্ত হয়। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে হঠাৎ দিনের বেলায় রাতের অন্ধকার নেমে আসে এবং চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশে হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেখা যায়। পাখিরা সন্ধ্যার আভাস পেয়ে ফিরে যেতে থাকে বনে, বাতাস যেন স্থির হয়ে যায়, হঠাৎ তাপমাত্রা কমতে থাকে।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনুযায়ী চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণ বেশিবার হয়। প্রতি সাতটি গ্রহণের মধ্যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের অনুপাত ৫:২ বা ৪:৩। তবে অধিকাংশ সূর্যগ্রহণ সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠে বা পর্বতমালার ওপর দিয়ে গেলে নজড়ে পড়ে না। জনাকীর্ণ লোকালয়ের ওপর দিয়ে তা গেলে তবেই প্রাধান্য পায়, যেখানে যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পাওয়া যায়। এই সুযোগ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিজ নিজ বিষয়ে নানা গবেষণা চালাবার সুযোগ নেন। যদিও গ্রহণ ছাড়া কৃত্রিমভাবে করোনোগ্রাফ দিয়ে সূর্যকে ঢেকে ছটামণ্ডলের ছবি তোলা বা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, কিন্তু পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ছাড়া কতগুলি বিশেষ বিষয় পর্যবেক্ষণ করা সম্বব হয় না। তাছাড়া অন্যভাবে প্রাপ্ত তথ্যাবলী সাধারণত এই সময়ে মিলিয়ে নেওয়া হয়। সূর্যের সাধারণ অবস্থায় আমরা এর আলোকমণ্ডল দেখি। কিন্তু সূর্যের ছটামণ্ডল, আবহমণ্ডল, ক্রোমোস্ফীয়ার ইত্যাদি দেখা যায় না। শুধু সূর্যগ্রহণেই তাদের ছটা দেখার সুযোগ আসে। তবে মজার বিষয় হলো ১৮৬৮ সালের ১৮ই আগস্টের পূর্ণগ্রাস সূর্যগহণের সময় ভারতের মানমন্দির থেকে প্রথম আবহাওয়ায় হিলিয়ামের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এরপর আরও ২৭ বছর পরে পৃথিবীতে হিলিয়ামের আবিষ্কার সম্ভব হয়। সূর্যের অভ্যন্তরে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬৫.৭ কোটি টন হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে ৬৫.২৫৬ কোটি টন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা সূর্যের শক্তির প্রধান উৎস। ১৯১৯ সালের পূর্ণগ্রাস সূর্যগহণের সময় ব্রিটেনের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি ও আইনস্টাইনের বক্তব্য যে আলোর ভর আছে এবং তা মাধ্যাকর্ষণের দ্বারা আকর্ষিত হয়, এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন এবং ব্রাজিলের সরোবন এবং গিনি উপসাগরের প্রিনসিপ দ্বীপে দুটি গবেষণাদল পাঠানো হয়, যারা ঐ তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করেন।
সূর্য গ্ৰহণের প্রকারভেদ
সাধারণত চার প্রকারের সূর্যগ্রহণ দেখা যায়:
- পূর্ণ সূর্যগ্রহণ - এক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণে চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে, ফলে কোনো স্থানে তখন হয় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। পূর্ণ সূর্যগ্রহণে সূর্য পুরো ঢাকা পড়ে যায় বলে তখন সৌরমুকুট দেখা যায়।
- বলয় সূর্যগ্রহণ - এক্ষেত্রে চাঁদের কৌণিক ব্যাস সূর্যের চেয়ে ছোট হলে হবে বলয় গ্রহণ। অমাবস্যার সময় সাধারণত সূর্যগ্রহণ হয় তবে সব অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয় না, কারণ চাঁদ ভূ-কক্ষের সাথে ৫ ডিগ্রী হেলে থাকে তখন।
- হাইব্রিড সূর্যগ্রহণ
- আংশিক সূর্যগ্রহণ - এসময় অন্যত্র তখন চাঁদ সূর্যেকে আংশিক ঢেকে রাখায় আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যায়।
সূর্য গ্ৰহণকে নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
সূর্য গ্রহণ নিয়ে সমাজে অনেক ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। ঐ সময়ে খেতে নেই, তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি সূর্য গ্রহণ দেখাও অনেকের কাছে নিষেধ। সূর্যকে গিলে ফেলা রাহুর ভয়ে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে বলে জ্যোতিষীরা দাবী করেন। কিন্তু আজকের দিনে আমরা যখন পরিষ্কার বুঝতে পারি পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে চাঁদ এসে যাওয়ার ফলে গ্রহণ হচ্ছে, তাই নতুন জীবাণুর জন্ম, রশ্মির বেশি প্রভাব ইত্যাদি প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ একটি চমৎকার প্রাকৃতিক ঘটনা যা পর্যবেক্ষণের জন্য অনেক লোক দূর-দূরান্তেও ভ্রমণ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ৯ মার্চ ২০১৬ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মাঝে এ ঘটনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।